বাংলাদেশের মানুষের জন্য মার্চ অত্যন্ত ঘটনাবহুল মাস। ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের জন্যও মাসটি বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইস্পাতকঠিন হয়ে ভারত বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ায়। ঘটনাবহুল কারনে মার্চ মাস বাঙ্গালী জাতির কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
শক্তিশালী পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রারম্ভে অকূল সাগরে উজ্জ্বল দ্বীপের মতো ভারতের পার্লামেন্টে পাস হয় সেই ঐতিহাসিক প্রস্তাব। ওই প্রস্তাবে বলা হয়—”This house records its profound conviction that the historic upsurge of the 75 million people of East Bengal will triumph. The House wishes to assure them that their struggle and sacrifices will receive the wholehearted sympathy and support of the people of India. (সূত্র সারেন্ডার অ্যাট ঢাকা-জেনারেল জ্যাকব, পৃ. ২০৯)।তারপর ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সর্বাত্মক সহযোগিতায় আমরা পাকিস্তানকে সম্পূর্ণভাবে পরাজিত করতে সক্ষম হই। দক্ষিণ এশিয়ার নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হয়, যা উপমহাদেশের আন্তরাষ্ট্রীয় সম্পর্কের সব হিসাব-কিতাব পাল্টে দেয়, অভ্যুদয় ঘটে নতুন সমীকরণের, প্রতিষ্ঠিত হয় নতুন মাইলফলক।
১৯৭২ সালের ২৩ মার্চ ঢাকায় অবস্থানকারী ভারতীয় সেনাবাহিনীর সর্বশেষ দল আনুষ্ঠানিক কুচকাওয়াজের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকে সালাম জানিয়ে ভারতে ফেরত যায়। ১৯৭২ সালের এই মার্চ মাসেই ভারতের মহীয়সী নেত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশ সফরে আসেন। ওই সফরের সময় ১৯ মার্চ দুই দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত হয় ২৫ বছরমেয়াদি বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী ও শান্তি চুক্তি।
বর্তমান এই সময়ে দুই দেশের সম্পর্ক যখন আবার একাত্তর-বাহাত্তরের উচ্চতায় উঠে আকাশ ছোঁয়ার প্রত্যাশা জেগে উঠছে, তখন পেছনে ফিরে সম্পর্কের শিকড়ের দিকে একটু তাকানো দরকার এই কারণে যে; তাতে বোঝা যাবে ৪৯ বছর পরও আজকের বাস্তবতায় দুই দেশের প্রারম্ভিক যাত্রা কতখানি প্রজ্ঞাময় ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ছিল। এতে সবার আত্মবিশ্বাস আরো বাড়বে, বুঝতে পারবে আমরা সঠিক পথেই আছি।
একটি মুখবন্ধসহ মোট ১২টি অনুচ্ছেদ ছিল ওই চুক্তিতে। কিন্তু নিবন্ধের সংক্ষিপ্তকরণের স্বার্থে শুধু গুরুত্বপূর্ণ চারটি অনুচ্ছেদ এখানে তুলে ধরছি।অনুচ্ছেদ এক. চুক্তিকারী উভয় পক্ষ স্ব-স্ব দেশের জনগণ যে আদর্শের জন্য একযোগে সংগ্রাম ও স্বার্থ ত্যাগ করেছে, সেই আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে একে অপরের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক অখণ্ডতার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করবে এবং অপরের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ থেকে বিরত থাকবে।
অনুচ্ছেদ ছয়. বন্যা নিয়ন্ত্রণ, নদী অববাহিকার উন্নয়ন ও জলবিদ্যুৎ, জ্বালানি ও সেচ ব্যবস্থার উন্নয়নের ক্ষেত্রে যৌথ সমীক্ষা পরিচালনা ও যৌথ কার্যক্রম গ্রহণে চুক্তিকারী উভয় পক্ষ অভিন্ন মত পোষণ করে।
অনুচ্ছেদ আট. দুই দেশের মধ্যকার বর্তমান গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক অনুযায়ী চুক্তিকারী উভয় পক্ষ ঘোষণা করছে, তারা একে অপরের বিরুদ্ধে পরিচালিত কোনো সামরিক চুক্তিতে আবদ্ধ হবে না বা অংশ নেবে না। অন্যের ওপর আক্রমণ থেকেও নিবৃত্ত থাকবে এবং তাদের ভূখণ্ডে এমন কোনো কাজ করতে দেবে না যাতে চুক্তিকারী কোনো পক্ষের ক্ষতি হতে পারে বা তা কোনো পক্ষের নিরাপত্তার হুমকি হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
অনুচ্ছেদ ৯. কোনো একপক্ষের বিরুদ্ধে তৃতীয় পক্ষ সশস্ত্র সংঘর্ষে লিপ্ত হলে চুক্তিকারী প্রত্যেকে এতদুল্লিখিত তৃতীয় পক্ষকে যেকোনো ধরনের সাহায্যদানে বিরত থাকবে। তা ছাড়া যেকোনো পক্ষ আক্রান্ত হলে অথবা আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিলে সেই আশঙ্কা নিশ্চিহ্ন করার উদ্দেশ্যে যথাযথ সক্রিয় ব্যবস্থা নিতে উভয় পক্ষ সঙ্গে সঙ্গে আলোচনায় মিলিত হয়ে নিজেদের শান্তি ও নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করবে।
পরিপূর্ণ চুক্তিটি এখন বাংলাদেশের অনেক বইপত্র ও লাইব্রেরিতে পাওয়া যায়। ইচ্ছা করলে যে কেউ সহজেই দেখতে পারেন।
আলোচ্য ১৯৭২ সালের চুক্তির এক নম্বর অনুচ্ছেদই দুই দেশের সম্পর্কের মূল ভিত্তি। দুই দেশের রাষ্ট্রদর্শন ও ব্যবস্থার মিলের কারণেই সম্পর্কের শুরু।বিগত ৪৮ বছরের ঘটনাপ্রবাহ পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, দুই দেশের মধ্যে রাষ্ট্রীয় আদর্শগত মিল যখন থেকেছে, তখন সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটেছে এবং আদর্শগত মিল যখন ছিল না তখন সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে। অভিন্ন নদীর পানি, বিদ্যুৎ ও বন্যা নিয়ন্ত্রণের মতো বড় সমস্যা সমাধানের জন্য এখন দল-মত-নির্বিশেষে সবাই যা বলছেন, তা কিন্তু ওই চুক্তির ছয় নম্বর অনুচ্ছেদেরই প্রতিধ্বনি।
উপরে উল্লিখিত অনুচ্ছেদ ৮ একটু মনোযোগ দিয়ে পড়লে বোঝা যায় ৪৮ বছর পরও আজকে দুই দেশের অভিন্ন নিরাপত্তার হুমকি মোকাবিলার জন্য কত বড় প্রজ্ঞা ও দূরদৃষ্টির পরিচয় তখন দেওয়া হয়েছে। উগ্রবাদী জঙ্গিগোষ্ঠীর আন্তসীমান্ত অপরাধ দমন ও এক দেশে অপরাধ করে যাতে অন্য দেশে আশ্রয় না পায়, তার প্রতি উভয় দেশ অঙ্গীকারবদ্ধ হয়েছে।
অনেক বছর আগে পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমানের খাগড়াগড়ে বাংলাদেশের জঙ্গি সংগঠন জেএমবির আশ্রয় গ্রহণ, সেখানে বসে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার পরিকল্পনা ও বাংলাদেশের ভেতরে জঙ্গি তৎপরতা চালানোর প্রস্তুতির খবর ও তার পরের ঘটনাপ্রবাহ পর্যালোচনা করলে এই আট অনুচ্ছেদের অপরিহার্যতা বোঝা যায়।
তা ছাড়া পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের পৃষ্ঠপোষকতা লাভকারী জঙ্গি সংগঠন লস্কর-এ-তৈয়বা, জইশ-এ-মোহাম্মদের জঙ্গিরা ২০০১-২০০৮ সময়ে ভারতে তৎপরতা চালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। যারা ২০০৯ সালে এসে বাংলাদেশে গ্রেপ্তার হয়েছে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
পাকিস্তান এখনো ভারত ও বাংলাদেশের বিরুদ্ধে জঙ্গি তৎপরতার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত, যার সাম্প্রতিক একাধিক প্রমাণ পাওয়া গেছে। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদীরা বাংলাদেশের ভূখণ্ডে আশ্রয় পেলে সেটি উভয় দেশের জন্য কত বড় নিরাপত্তার হুমকি সৃষ্টি করতে পারে তার উদাহরণ ২০০১-২০০৬ মেয়াদে সবাই দেখেছেন, যখন বাংলাদেশে ক্ষমতায় ছিল জামায়াত-বিএনপি সরকার।
উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোর নিরাপত্তা ভারতের জাতীয় ও ভূখণ্ডগত নিরাপত্তার অতি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। তাই ভারত-বাংলাদেশের নিরাপত্তা আজ একই সূত্রে গাঁথা। আর উন্নয়ন ও নিরাপত্তা মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ মাত্র। সুতরাং ৪৮ বছর আগে স্বাক্ষরিত আলোচ্য চুক্তির অষ্টম অনুচ্ছেদ আজও উভয় দেশের নিরাপত্তার জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য। এখন সহজে প্রাপ্য বাহাত্তরের এই ঐতিহাসিক চুক্তির অনুচ্ছেদগুলো পড়লে যে কেউ বুঝবেন এর কোথাও এমন কোনো শর্ত ও বিষয় নেই যা একতরফাভাবে শুধু বাংলাদেশের জন্য প্রযোজ্য ছিল।
১৯৭৫ সালের পর বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় এসে শুধু ক্ষমতা ভোগ করার জন্য সংকীর্ণ ও সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ধর্মের নামে জনগণকে ভুল বুঝিয়ে যারা এই চুক্তির ওপর কালিমা লেপন করেছেন তাদের এখনো শুভবুদ্ধির উদয় হয়নি। তাই জনগণকে ভূমিকা রাখতে হবে, উপলব্ধি করতে হবে কোনটি সঠিক, কোনটি সঠিক নয়।
আজ বাংলাদেশের জন্য ভারতের সহযোগিতা যেমন প্রয়োজন তেমনি বাংলাদেশের সহযোগিতাও একইভাবে ভারতের জন্য প্রয়োজন। তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি ও সীমান্ত হত্যার মতো সংবেদনশীল দু-একটি বিষয়ে ভারতকে গভীর দৃষ্টি দিয়ে বুঝতে হবে, যাতে বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী ধর্মীয় উসকানি ছড়ানোর সুযোগ না পায়। একবিংশ শতাব্দীর বাস্তবতা সামনে রেখেই বাংলাদেশ-ভারত দুই দেশেরই উন্নয়ন ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে, ভারত-বাংলাদেশকে একসঙ্গে চলতে হবে।